মশাবাহিত রোগ জিকা

নতুনদেশ ডেস্ক
প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:১৭ এএম

বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) ক্রোড়পত্র অবলম্বনে লিখেছেন মো. রাকিব
জিকা একটি ভাইরাসজনিত সংক্রামক ব্যাধি। বর্তমানে নতুনভাবে বিস্তার লাভ করা এ রোগটি ১৯৪৭ সালে প্রথম উগান্ডার জিকা নামক বনাঞ্চলের বানরের মধ্যে শনাক্ত হয়। ১৯৫২ সালে উগান্ডা ও তানজানিয়াতে মানুষের মাঝে প্রথম এ রোগের সংক্রমণ ঘটে। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মতো এটি প্রধানত এডিস মশাবাহিত রোগ। পরে ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে এ রোগটি আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে এবং মাইক্রোনেশিয়ার ইয়াপ দ্বীপে ২০০৭ সালে প্রথম বড় ধরনের প্রাদুর্ভাব পরিলক্ষিত হয়। ব্রাজিলে ২০১৫ সাল থেকে চলে আসা জিকার প্রাদুর্ভাব নিয়ে গবেষণা চলছে। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে জিকার সঙ্গে শিশুর জন্মগত মাইক্রোসেফালি (ক্ষুদ্রতর মস্তিষ্ক) ও স্নায়ুর অবশজনিত রোগের (গিলেন-বারি সিনন্ড্রোম) সম্পর্ক ধরা পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি বলে ঘোষণা করেছে।
জিকা ভাইরাস কী?
জিকা ভাইরাস ফ্ল্যাভি ভাইরাস গোত্রের ভাইরাস। মশাবাহিত হওয়ার কারণে একে আরবো ভাইরাসও বলে। এ গোত্রের অন্যান্য ভাইরাসের মধ্যে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশে দেখা যায়।
জিকা ভাইরাস কীভাবে ছড়ায়
প্রাথমিকভাবে জিকা ভাইরাস আক্রান্ত এডিস ইজিপ্টাই অথবা এডিস অ্যালবুপিক্টাস মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। এ ধরনের মশা সাধারণত দিনের বেলা (ভোর অথবা সন্ধ্যার সময়) কামড়ায়। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া সংক্রমণের জন্যেও এই মশাই দায়ী।
আক্রান্ত পুরুষ রোগীর সঙ্গে অনিরাপদ যৌন সংসর্গ করলে (কন্ডোম ব্যবহার না করলে) পুরুষ থেকে নারীদের মাঝে এ রোগ ছড়াতে পারে।
অন্তঃসত্ত্বা নারী গর্ভের প্রথম তিন মাসের মধ্যে জিকা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে, গর্ভের সন্তান এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
এ ছাড়া জিকা ভাইরাস আক্রান্ত রক্তদাতার রক্ত গ্রহণ করলে এবং ল্যাবরেটরিতে নমুনা পরীক্ষার সময় অসাবধানতাবশত এ রোগ ছড়াতে পারে।
জিকা ভাইরাস সংক্রমণের উপসর্গগুলো
সাধারণত শতকরা ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে জিকা ভাইরাস আক্রান্ত মানুষের মধ্যে রোগের কোনো লক্ষণ প্রকাশিত হয় না। অন্যান্য ক্ষেত্রে, আক্রান্ত হওয়ার তিন থেকে ১২ দিনের মধ্যে উপসর্গগুলো দেখা যায় এবং সেগুলো দুই থেকে সাত দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। অধিকাংশ সময় এ রোগটি নিজে নিজে ভালো হয়ে যায়। জিকা আক্রান্ত কোনো দেশ থেকে ফিরে আসার ১৪ দিনের মধ্যে স্বল্প মাত্রার জ্বর (৯৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট/ ৩৭.২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের বেশি) অথবা চামড়ায় লালচে দানার মতো র্যাশ এবং এর সঙ্গে মাথাব্যথা, চোখ লাল হওয়া (চোখের প্রদাহ), মাংসপেশিতে ব্যথা, গিটে গিটে ব্যথার মতো যেকোনো একটি উপসর্গ দেখা দিলে জিকা ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে।
জিকা ভাইরাস সংক্রমণের জটিলতা
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় যে, গর্ভাবস্থায় মায়ের জিকা ভাইরাস সংক্রমণ হলে শিশুদের জন্মগত রোগ মাইক্রোসেফালি (Microcephaly) অর্থাৎ মস্তিষ্ক ও মাথার আকার তুলনামূলক ছোট হওয়ার (১ শতাংশের কম) আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া খুবই অল্প ক্ষেত্রে স্নায়ুর অবশজনিত রোগ গিলেন-বারি সিনন্ড্রোম (Guillain-Barré syndrome) হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
রোগ নির্ণয়
জিকা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে এমন কোনো দেশ থেকে ফিরে আসার পর উপরোল্লিখিত উপসর্গগুলো দেখা দিলে, উক্ত ব্যক্তির জিকা ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। উপসর্গগুলো শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যে জিকা আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে ভাইরাসটি (Serology এবং RT-PCR) পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করা যায়। এ ছাড়া এক মাসের মধ্যে রোগীর প্রস্রাব এবং দুই মাস পর্যন্ত পুরুষ রোগীর বীর্য পরীক্ষার মাধ্যমে এ রোগ নির্ণয় করা যায়। বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর) জিকা রোগ নির্ণয়ের সব পরীক্ষা করা হয়।
চিকিৎসা
জিকা ভাইরাস সংক্রমণের চিকিৎসা মূলত উপসর্গভিত্তিক। এর কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। আক্রান্ত ব্যক্তিকে বিশ্রাম নিতে হবে। প্রচুর পানি ও তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে। প্রয়োজনে জ্বর ও ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল ট্যাবলেট এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক ওষুধ খেতে হবে। কোনো কারণে রোগীর অবস্থার অবনতি হলে সময় নষ্ট না করে কাছের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করতে হবে।
জিকা সংক্রমণ প্রতিরোধের উপায়গুলো
জিকা ভাইরাস সংক্রমণের প্রতিষেধক টিকা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। ব্যক্তিগত সচেতনতাই জিকা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের প্রধান উপায়।
মশার কামড় থেকে সুরক্ষাই জিকা থেকে বাঁচার সবচেয়ে ভালো উপায়। শরীরের বেশির ভাগ অংশ ঢাকা রাখা (ফুল হাতা শার্ট এবং ফুল প্যান্ট পরা), জানালায় নেট লাগানো, প্রয়োজন ছাড়া দরজা জানালা খোলা না রাখা, ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করা, শরীরে মশা প্রতিরোধক ক্রিম ব্যবহার করার মাধ্যমে মশার কামড় থেকে বাঁচা যায়। শিশু, অসুস্থ ব্যক্তি এবং বয়স্কদের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। আবাসস্থল ও এর আশপাশে মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করতে হবে। বাসার আশপাশে ফেলে রাখা মাটির পাত্র, কলসি, বালতি, ড্রাম, ডাবের খোলা ইত্যাদি যেসব স্থানে পানি জমতে পারে, সেখানে এডিস মশা প্রজনন করতে পারে। তাই এসব জায়গা পরিষ্কার রাখতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী, জিকা আক্রান্ত কোনো দেশ থেকে ফিরে আসার পর জিকা ভাইরাস সংক্রমণের উপসর্গ ব্যতিরেকে সব পুরুষ ও নারীকে অন্তত ছয় মাস পর্যন্ত যৌন সংসর্গকালে নিরাপদ পদ্ধতি (কন্ডম) ব্যবহার করতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী, গর্ভকালীন জিকা আক্রান্ত দেশগুলোয় ভ্রমণ থেকে বিরত থাকতে হবে। গর্ভকালীন জিকা আক্রান্ত দেশগুলোয় ভ্রমণ করলে অবশ্যই মশার কামড় থেকে সুরক্ষিত থাকার নিয়মাবলি মেনে চলতে হবে।
জিকা আক্রান্ত দেশগুলো ভ্রমণকালীন মশার কামড় থেকে সুরক্ষিত থাকার নিয়মাবলি মেনে চলতে হবে।